যুবাইর ইবনুল ‘আওয়াম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মৃত্যু ও তার ঋণ পরিশোধের ঘটনা।

যুবাইর ইবনুল ‘আওয়াম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মৃত্যু ও তার ঋণ পরিশোধের ঘটনা।

আবূ খুবাইব আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর(রাদ্বিয়াল্লাহু ‘‘আনহুমা) বলেন, যখন আমার পিতা যুবাইর)‘জামাল’ যুদ্ধের দিন দাঁড়ালেন, তখন তিনি আমাকে ডাকলেন। সুতরাং আমি তাঁর পাশে দাঁড়ালাম। অতঃপর তিনি বললেন, ‘হে বৎস! আজকের দিন যারা খুন হবে সে অত্যাচারী হবে অথবা অত্যাচারিত। আমার ধারণা যে, আমি আজকে অত্যাচারিত হয়ে খুন হয়ে যাব। আর আমার সবচেয়ে বড় চিন্তা আমার ঋণের। (হে আমার পুত্র!) তুমি কি ধারণা করছ যে, আমার ঋণ আমার কিছু সম্পদ অবশিষ্ট রাখবে (অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ করার পর কিছু মাল বেচে যাবে)?’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘হে আমার পুত্র! তুমি আমার সম্পদ বেচে আমার ঋণ পরিশোধ করে দিও।’ আর তিনি এক তৃতীয়াংশ সম্পদ অসিয়ত করলেন এবং এক তৃতীয়াংশের এক তৃতীয়াংশ তাঁর অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর ছেলেদের জন্য অসিয়ত করলেন। তিনি বললেন, ‘যদি ঋণ পরিশোধ করার পর আমার কিছু সম্পদ বেঁচে যায়, তাহলে তার এক তৃতীয়াংশ তোমার ছেলেদের জন্য।’ (হাদীসের এক রাবী) হিশাম বলেন, আব্দুল্লাহর কিছু ছেলে যুবাইরের কিছু ছেলে খুবাইব ও আববাদের সমবয়স্ক ছিল। সে সময় তাঁর নয়টি ছেলে ও নয়টি মেয়ে ছিল। আব্দুল্লাহ বলেন, অতঃপর তিনি (যুবাইর) তাঁর ঋণের ব্যাপারে আমাকে অসিয়ত করতে থাকলেন এবং বললেন, ‘হে বৎস! যদি তুমি ঋণ পরিশোধ করতে অপারগ হয়ে যাও, তাহলে তুমি এ ব্যাপারে আমার মওলার সাহায্য নিও।’তিনি (আব্দুল্লাহ) বলেন, আল্লাহর কসম! তাঁর উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পারলাম না। পরিশেষে আমি বললাম, ‘আব্বাজান! আপনার মওলা কে?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ।’ আব্দুল্লাহ বলেন, অতঃপর আল্লাহর কসম! আমি তাঁর ঋণের ব্যাপারে যখনই কোন অসুবিধায় পড়েছি তখনই বলেছি, ‘হে যুবাইরের মওলা! তুমি তাঁর পক্ষ থেকে তাঁর ঋণ আদায় করে দাও।’ সুতরাং আল্লাহ তা আদায় করে দিয়েছেন।আব্দুল্লাহ বলেন, (সেই যুদ্ধে) যুবাইর খুন হয়ে গেলেন এবং তিনি (নগদ) একটি দীনার ও দিরহামও ছেড়ে গেলেন না। কেবল জমি-জায়গা ছেড়ে গেলেন; তার মধ্যে একটি জমি ‘গাবাহ’ ছিল আর এগারোটি ঘর ছিল মদীনায়, দু’টি বাসরায়, একটি কুফায় এবং একটি মিসরে।তিনি বলেন, আমার পিতার ঋণ এইভাবে হয়েছিল যে, কোনো লোক তাঁর কাছে আমানত রাখার জন্য মাল নিয়ে আসত। অতঃপর যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন, ‘না, (আমানত হিসাবে নয়) বরং তা আমার কাছে ঋণ হিসাবে থাকবে। কেননা, আমি তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।’ (কারণ আমানত নষ্ট হলে তা আদায় করা জরুরী নয়, কিন্তু ঋণ আদায় করা সর্বাবস্থায় জরুরী)।তিনি কখনও গভর্নর হননি, না কদাচ তিনি ট্যাক্স, খাজনা বা অন্য কোন অর্থ আদায় করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।(যাতে তাঁর মাল সংগ্রহে কোন সন্দেহ থাকতে পারে।) অবশ্য তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবূ বাকর, উমর ও উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের সঙ্গে জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন (এবং তাতে গনীমত হিসাবে যা পেয়েছিলেন সে কথা ভিন্ন)। আব্দুল্লাহ বলেন, একদা আমি তাঁর ঋণ হিসাব করলাম, তো (সর্বমোট) ২২ লাখ পেলাম। অতঃপর হাকীম ইবনে হিযাম আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। হাকীম বললেন, ‘হে ভাতিজা! আমার ভাই (যুবাইর)এর উপর কত ঋণ আছে?’ আমি তা গোপন করলাম এবং বললাম, ‘এক লাখ।’ পুনরায় হাকীম বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমার মনে হয় না যে, তোমাদের সম্পদ এই ঋণ পরিশোধে যথেষ্ট হবে।’ আব্দুল্লাহ বললেন, ‘ কী রায় আপনার যদি ২২ লাখ হয়?’ তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় না যে, তোমরা এ পরিশোধ করার ক্ষমতা রাখো। সুতরাং তোমরা যদি কিছু পরিশোধে অসমর্থ হয়ে পড়, তাহলে আমার সহযোগিতা নিও।’ যুবাইর এক লাখ সত্তর হাজারের বিনিময়ে ‘গাবাহ’ কিনেছিলেন।অতঃপর আব্দুল্লাহ সেটি ১৬ লাখের বিনিময়ে বিক্রি করলেন। অতঃপর তিনি দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন যে, ‘যুবাইরের উপর যার ঋণ আছে সে আমার সঙ্গে ‘গাবাহ’তে সাক্ষাৎ করুক।’ (ঘোষণা শুনে) আব্দুল্লাহ ইবনে জা’ফর তাঁর নিকট এলেন। যুবাইরকে দেওয়া তাঁর ৪ লাখ ঋণ ছিল। তিনি আব্দুল্লাহকে বললেন, ‘তোমরা যদি চাও, তবে এ ঋণ তোমাদের জন্য মওকুফ করে দেব?’ আব্দুল্লাহ বললেন, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘যদি তোমরা চাও যে, ঋণ (এখন আদায় না করে) পরে আদায় করবে, তাহলে তাও করতে পার।’ আব্দুল্লাহ বললেন, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি আমাকে এই জমির এক অংশ দিয়ে দাও।’ আব্দুল্লাহ বললেন, ‘এখান থেকে এখান পর্যন্ত তোমার রইল।’ অতঃপর আব্দুল্লাহ ঐ জমি (ও বাড়ি)র কিছু অংশ বিক্রি করে তাঁর (পিতার) ঋণ পরিপূর্ণরূপে পরিশোধ করে দিলেন। আর ঐ ‘গাবাহ’র সাড়ে চার ভাগ বাকী থাকল। অতঃপর তিনি মুআবিয়াহর কাছে এলেন এমতাবস্থায় যে, তাঁর কাছে ‘আমর ইবনে উসমান, মুনযির ইবনে যুবাইর এবং ইবনে যাম‘আহ উপস্থিত ছিলেন। মু‘আবিয়াহ তাঁকে বললেন, ‘গাবাহর কত দাম হয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক ভাগের এক লাখ।’ তিনি বললেন, ‘কয়টি ভাগ বাকী রয়ে গেছে?’ তিনি বললেন, ‘সাড়ে চার ভাগ।’ মুনযির ইবনে যুবাইর বললেন, ‘আমি তার মধ্যে একটি ভাগ এক লাখে নিয়ে নিলাম।’ ‘আমর ইবনে উসমান বললেন, ‘আমিও এক ভাগ এক লাখে নিয়ে নিলাম।’ ইবনে যাম‘আহ বললেন, ‘আমিও এক ভাগ এক লাখে নিয়ে নিলাম।’ অবশেষে মু‘আবিয়াহ বললেন, ‘আর কত ভাগ বাকী থাকল?’ তিনি বললেন, ‘দেড় ভাগ।’ তিনি বললেন, ‘আমি দেড় লাখে তা নিয়ে নিলাম।’ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে জা’ফর তাঁর ভাগটি মু‘আবিয়ার কাছে ছয় লাখে বিক্রি করলেন।’ অতঃপর যখন ইবনে যুবাইর ঋণ পরিশোধ করে শেষ করলেন, তখন যুবাইরের ছেলেরা বলল, ‘(এবার) তুমি আমাদের মধ্যে আমাদের মীরাস বণ্টন করে দাও।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের মধ্যে (তা) বণ্টন করব না, যতক্ষণ না আমি চার বছর হজ্জের মৌসমে ঘোষণা করব যে, যুবাইরের উপর যার ঋণ আছে সে আমাদের কাছে আসুক, আমরা তা পরিশোধ করে দেব।’ অতঃপর তিনি প্রত্যেক বছর (হজ্জের) মৌসমে ঘোষণা করতে থাকলেন। অবশেষে যখন চার বছর পার হয়ে গেল, তখন তিনি তাদের মধ্যে (মীরাস) বণ্টন করে দিলেন এবং এক তৃতীয়াংশ মাল (যাদেরকে দেওয়ার অসিয়ত ছিল তাদেরকে তা) দিয়ে দিলেন। আর যুবাইরের চারটি স্ত্রী ছিল। প্রত্যেক স্ত্রীর ভাগে পড়ল বারো লাখ ক’রে। তাঁর সর্বমোট পরিত্যক্ত সম্পদ ছিল পাঁচ কোটি দু’লাখ।

[সহীহ] [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন।]

الشرح

উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হত্যাকারীকে প্রত্যর্পণের জন্য সংঘটিত উষ্ট্রযুদ্ধের দিন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার পুত্র আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে ডেকে বললেন, “আমার মনে হয়, আমি আজ মাযলুম হিসেবে শহীদ হবো। আর আমি আমার ঋণ সম্পর্কে বেশি চিন্তিত। তাই তুমি আমার ঋণ পরিশোধ করে দিবে। তার সমূদয় সম্পত্তির পরিমাণ ছিলো ঋণ। এতদ্সত্ত্বেও তিনি তার পুত্রের পুত্রদের জন্য (অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়েরের পুত্রদের জন্যে) অসিয়াত করে গিয়েছিলেন। কেননা তিনি জানতেন যে, তার মৃত্যুর পর তার পুত্র আব্দুল্লাহ জীবিত থাকায় তার (আব্দুল্লাহর) সন্তানেরা তার (যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর) সম্পদে ওয়ারিশ হবে না। তাই তিনি (আব্দুল্লাহর) সন্তানদের জন্য তৃতীয়াংশের তৃতীয়াংশ অসিয়াত করেন, যা মূল সম্পদের নয় ভাগের একভাগ। তার উপর ঋণ থাকার কারণ এই ছিল যে, তাঁর নিকট কেউ যখন কোনো মাল আমানত রাখতে আসতো তখন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, না, এভাবে নয়’ তুমি তা আমার কাছে ঋণ হিসাবে রেখে যাও। কেননা, আমি ভয় করছি যে, তোমার মাল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তিনি একজন আল্লাহ ভীরু আমানতদার ছিলেন। তিনি কখনো কোনো প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। তিনি মারা গেলে তার সমূদয় ঋণ তার পুত্র আব্দুল্লাহ আদায় করে দেন। তার ঋণ আদায়ের পরে কিছু সম্পদ অবশিষ্ট থাকলে তার ওয়ারিশগণ তা বণ্টন করে দিতে অনুরোধ করলে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তা অস্বীকার করে বলেন, যতক্ষণ আমি হজ্জের মৌসুমে তার ঋণের ঘোষণা প্রচার না করব, যদি স্পষ্ট হয় যে তার কাছে আর কারো ঋণ নেই তখন আমি তার সম্পদ ওয়ারিশদের মাঝে বণ্টন করব। অতঃপর তিনি তাই করলেন। অতঃপর যখন তার সমূদয় ঋণ আদায় হলো তিনি তার স্ত্রীদেরকে (যুবায়েরের) অষ্টমাংশ বণ্টন করেন। এটি ছিলো তাদের মিরাসের অংশ। আর সে সময় যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর চারজন স্ত্রী ছিলেন।

التصنيفات

সাহাবীগণের ফযীলত, মহান ব্যক্তিবর্গের জীবনী ও আদর্শ